শুক্রবার, ৫ই জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২১শে আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাঁতার শেখার বিষয়টি কি শুধু কাগজে-কলমেই থাকবে

সম্পাদকীয়

🕒 প্রকাশ: ১১:৩৯ পূর্বাহ্ন, ৩১শে জুলাই ২০২৩

#

ছবি: সংগৃহীত

রাজশাহীর একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করে মায়েশা আক্তার (ছদ্ম নাম)। সে নগরীর পাঠানপাড়ায় বাবা মায়ের সঙ্গে বসবাস করে। নিজ উদ্যোগে সপ্তাহে দুইদিন সাঁতার শেখে মায়েশা।

মায়েশা জানায়, ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াশোনাকালে সে স্কুলে সাঁতার শিখতে চেয়েছিল। কিন্তু স্কুলে কোনো পুকুর নেই। এমনকি শিক্ষকরাও তাকে শেখানোর কোনো ব্যবস্থা করেননি। তাই পরিবার থেকেই রাজশাহী জেলা স্টেডিয়ামের সুইমিংপুলে সাঁতার শেখানো হচ্ছে। এখন সে নিয়মিত সাঁতার কাটে।

স্কুল-কলেজসহ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের সাঁতার প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনের ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছে সরকার। তবুও মায়েশাকে নিজ দায়িত্বেই সাঁতার শিখতে হচ্ছে। কারণ, রাজশাহীতে কোনো প্রতিষ্ঠানেই এখন সাঁতার শেখানো হয় না। এমনকি এটি মনিটরিংয়ে যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাদের অনেকে বিষয়টি সম্পর্কে জানেনই না।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ২০১৫ সালে এপ্রিল মাসে মন্ত্রণালয় থেকে সাঁতার শেখা বাধ্যতামূলক করে একটি পরিপত্র জারি করা হয়। এতে বলা হয়েছে, পানিতে ডুবে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে সাঁতার শেখার জন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আবশ্যিকভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে।

কোনো স্কুল-কলেজে পুকুর না থাকলে পাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পুকুর ব্যবহার করতে হবে। শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর এসব পুকুর সংস্কার করবে। মালিকানা, ব্যবহার করতে না দেওয়া বা অন্য কোনো সমস্যা দেখা দিলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তা সমাধান করবেন।

মহানগরীর যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পুকুর বা উপযুক্ত জলাশয় নেই তাদের মহানগরীর কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় ক্রীড়া কমপ্লেক্স বা অন্য যে কোনো প্রতিষ্ঠানে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সাঁতার প্রশিক্ষণ দিতে হবে। প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আবশ্যিকভাবে লাইফ জ্যাকেটের ব্যবস্থা করতে হবে।

পাশাপাশি দেশীয় প্রচলিত সরঞ্জাম ব্যবহার করেও শিক্ষার্থীদের সাঁতার শেখানো যাবে। সাঁতার শেখানোর সময় শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক অথবা প্রশিক্ষককে অবশ্যই উপস্থিত থাকতে হবে। এক্ষেত্রে ছেলে ও মেয়েদের জন্য আলাদা সময় নির্ধারণ করতে হবে।

এ প্রশিক্ষণের তদারকির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও ইউএনওদের। তারা তিন মাস পর পর মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) কাছে প্রতিবেদন দেবেন। মাউশি তিন মাস অন্তর এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠাবে। তবে এসব নির্দেশনা কাগজেই শেষ। বাস্তবে এমন কিছুই ঘটে না।

ফায়ার সার্ভিসের তথ্য মতে, রাজশাহী বিভাগে গত দুই মাসে নদী ও পুকুরে ডুবে মৃত্যু হয়েছে ২৫ জনের। এরমধ্যে শিশুই ২০ জন। বিভাগে পানিতে ডুবে মৃতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রাজশাহী জেলায়। এ জেলায় পুকুর ও নদীতে ডুবে আট শিশুসহ ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জের সাতজনের চারজন শিশু, জয়পুরহাট জেলায় এক শিশু, বগুড়ায় দুই শিশু, সিরাজগঞ্জে দুই শিশু, পাবনায় দুই শিশুসহ তিনজনের মৃত্যু হয়েছে।

রাজশাহী বিবি হিন্দু একাডেমির এক শিক্ষার্থী বললো, আমাদের এখানে তো কোনো পুকুর নেই। আমি এই স্কুলে পড়াশোনা করছি ছয় বছর ধরে। এখানে কোনোদিন সাঁতার শেখাতে দেখিনি। ওই শিক্ষার্থী আরও বললো, কয়েক বছর আগেও আমাদের এক সহপাঠী পানিতে ডুবে মারা গেছে। তখন কিছুদিন ক্লাসে বলতে শুনেছি সাঁতার শেখার কথা। কিন্তু কেউ কোনোদিন বাধ্যতামূলক করতেই হবে এটা বলেনি। এমনকি আমাদের নির্দেশনাও দেয়নি।

রাজশাহীর রিভারভিউ কালেক্টরেট স্কুলের এক শিক্ষার্থীর ভাষ্য, আমাদের এখানে একটি পুকুর আছে। তবে সেই পুকুরে পানি থাকে না। এটি অত্যন্ত অপরিষ্কার। আমাদের কাউকে কোনোদিন সাঁতার শেখানো হয়নি। কোনোদিন বলাও হয়নি সাঁতারের ক্লাস আছে।

রাজশাহী বিবি হিন্দু একাডেমির প্রধান শিক্ষক রাজেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, আমাদের এখানে কোনো পুকুর নেই। অনেকদিন আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিঠি পেয়ে আমরা উদ্যোগ নিয়েছিলাম। শিক্ষার্থীদের নোটিশও করেছিলাম। সবশেষ রোজার ছুটির আগেও নোটিশ করেছি। কিন্তু তেমন সাড়া পাইনি। এখন পরীক্ষা শেষ হলে আবারও সাঁতার শেখানোর উদ্যোগ নেব।

রাজশাহীর রিভারভিউ কালেক্টরেট স্কুলের প্রধান শিক্ষক মনোয়ারা পারভীন বলেন, আমাদের এখানে একটি পুকুর আছে। তবে সেটি ব্যবহার উপযোগী না। আমরা শিশুদের ছুটিতে নিজ দায়িত্বে সাঁতার শিখে নিতে বলি। অমি নিজেও নানাবাড়িতে গিয়ে সাঁতার শিখেছি। আমরা চিঠি পেয়েছিলাম। তবে কেউ আগ্রহী নয়।

বাংলাদেশ জাতীয় সাঁতার দলের সাবেক কোচ আলমগীর হোসেন বলেন, প্রতিবছর ৩০ হাজার শিশু-কিশোর পানিতে ডুবে মারা যায়। দেশের ৮০ শতাংশ শিশুই সাঁতার জানে না। আমাদের পদক্ষেপে সরকার প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে সাঁতার শেখা বাধ্যতামূলক করেছে। তবে স্কুলগুলোতে এখনো এটা চালু হয়নি। এটি চালু হলে অন্তত ৮০ শতাংশ শিশুর জীবন বাঁচানো যেত।

রাজশাহী জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নাসির উদ্দীন বলেন, আমরা চিঠি দিয়েছি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কিছুদিন সাঁতার চালিয়েছিল। এরপর বন্ধ হয়ে গেছে। তবে কোনো শিক্ষার্থীর কাছ থেকে সাঁতার না শেখানোর অভিযোগ পাওয়া যায়নি। আমরা আবারও বিষয়টি দেখবো।

আরও পড়ুন:

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ: কলকাতা পারলেও কেন পারছে না ঢাকা



শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

খবরটি শেয়ার করুন